সরকারের কোনো নীতি-নির্ধারণী বিষয়ে প্রভাব তৈরি করে এমন কোনো পর্যবেক্ষণ আদালত দিতে পারেন না বলে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন দেশের সর্ব্বোচ আদালত।
একুশে আগস্ট গ্রেনেড মামলার রায়ে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন ৬ বিচারপতির আপিল বেঞ্চ এ পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। রায়ের অনুলিপি ঢাকা পোস্টের হাতে এসেছে।
একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলাটি নতুন করে তদন্ত করা প্রয়োজন উল্লেখ করে হাইকোর্ট রায়ে যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছিলেন, তা সঠিক নয় উল্লেখ করে তা বাতিল করেছেন আপিল বিভাগ। এ নিয়ে আপিল বিভাগের রায়ে বলা হয়েছে, মামলার নথিভুক্ত তথ্য এবং বিদ্যমান পরিস্থিতির সঙ্গে এ পর্যবেক্ষণ সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এছাড়া কোনো নীতি-নির্ধারণী বিষয়ে প্রভাব তৈরি করে এমন কোনো পর্যবেক্ষণ আদালত দিতে পারেন না। ক্ষমতার পৃথকীকরণ নীতির ভিত্তিতে হাইকোর্টের এই পর্যবেক্ষণটি বাতিল করা প্রয়োজন। কারণ এই পর্যবেক্ষণ নীতি-নির্ধারণী বিষয়ে বিচারিক হস্তক্ষেপের সামিল।
একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় হাইকোর্টের খালাসের রায় বহাল রাখা প্রসঙ্গে আপিল বিভাগ তার রায়ে বলেছেন, এই মামলায় মুফতি হান্নানসহ ১২ জন আসামির স্বীকারোক্তিমূল জবানবন্দি নেওয়া হয়েছিল। যে পরিস্থিতিতে আসামিদের কাছ থেকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে, সেসব জবানবন্দি কতটুকু স্বতঃস্ফূর্ত ছিল তা নিয়ে গুরুতর সন্দেহ আছে। যেমন, কথিত মূল পরিকল্পনাকারী মুফতি আব্দুল হান্নান প্রথম স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ার চার বছর পর দ্বিতীয় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। দ্বিতীয় জবানবন্দির জন্য ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করার আগে তিনি দীর্ঘ সময় কনডেমড সেলে বন্দি ছিলেন। বাকি আসামিরাও দীর্ঘ সময় পুলিশি হেফাজতে থাকার পর ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে জবানবন্দি দেন। এছাড়া, তিনজন আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি একজন ম্যাজিস্ট্রেট একদিনে অস্বাভাবিক গতিতে রেকর্ড করেন, যা এ সংক্রান্ত নিয়ম-নীতির গুরুতর লঙ্ঘন। অধিকাংশ আসামি তাদের স্বীকারোক্তি প্রত্যাহার করার জন্য আবেদন করেছিলেন। তাদের যুক্তি ছিল- স্বীকারোক্তি নেওয়ার আগে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা তাদের অমানবিক নির্যাতন-নিপীড়ন করে এবং ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ছাড়া অবৈধভাবে হেফাজতে রেখেছিল। ফলে স্বীকারোক্তি স্বেচ্ছাপ্রণোদিত ছিল কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
সর্বোচ্চ আদালত বলেন, সবচেয়ে বড় কথা— কথিত অভিযুক্ত মুফতি আব্দুল হান্নানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করায় ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারা অনুসারে তাকে স্বীকারোক্তির বিষয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়নি, যা মামলাটিকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করেছে। ফলে এসব স্বীকারোক্তি হয় চাপ প্রয়োগ করে, নয় প্রতিকূল পরিস্থিতিতে আদায় করা হয়েছে, যা আইনের চোখে বিশ্বাসযোগ্য নয় বলে বিবেচিত হয়েছে।
সর্বোচ্চ আদালত বলেন, চূড়ান্ত বিশ্লেষণে এই স্বীকারোক্তিগুলো নির্ভরযোগ্যতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি। এ বিষয়টি হাইকোর্টের রায়ে উপেক্ষা করা হয়েছে, যা পর্যালোচনা করা উচিত ছিল।
এ পর্যবেক্ষণ ছাড়া হাইকোর্টের রায়ে কোনো ত্রুটি বা অবৈধ কিছু খুঁজে পাওয়া যায়নি উল্লেখ করে সর্বোচ্চ আদালত রায়ে বলেন, ‘ফলে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ বাতিল ও রায়ের কার্যকরী অংশে সংশোধন সাপেক্ষে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল খারিজ করা হলো। একই সঙ্গে হাইকোর্টের খালাসের রায় বহাল রাখা হলো। সাজাপ্রাপ্ত (বিচারিক আদালতের রায়ে) যেসব আসামি আপিল করেননি, খালাসের এই রায় তাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। এই মামলায় কারও বিরুদ্ধে পরোয়ানা থাকলে তা প্রত্যাহার করা হলো। আর আপিলের অনুমতির জন্য সংযুক্ত সমস্ত ফৌজদারি আবেদন নিষ্পত্তি করা হলো।
এদিকে আজ বৃহস্পতিবার (৪ সেপ্টেম্বর) বহুল আলোচিত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ সব আসামির খালাসের হাইকোর্টের রায় বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ।
একইসঙ্গে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা নতুন করে তদন্তে হাইকোর্ট যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছিলেন তা বাদ দিয়েছেন সর্ব্বোচ আদালত। আদালত বলেছেন, নতুন করে তদন্ত করবে কি না, সেটি সরকারের বিষয়।
এদিন সকাল ১০টা ৫ মিনিটে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে ৬ বিচারপতির আপিল বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন।
হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের দায়ের করা আপিল খারিজ করে আপিল বিভাগ এ রায় দেন।
বেঞ্চের অন্য ৫ জন হলেন, বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী, বিচারপতি মো. রেজাউল হক, বিচারপতি এস এম ইমদাদুল হক ও বিচারপতি ফারাহ মাহবুব।
আদালতে তারেক রহমান-বাবরের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট এস এম শাহজাহান, অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির।
আদালতে বিএনপির আইনজীবীদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, ব্যারিস্টার কায়সার কামাল, ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, অ্যাডভোকেট গাজী কামরুল ইসলাম সজল, অ্যাডভোকেট আমিনুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট মাকসুদ উল্লাহ, অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ ছিদ্দিক উল্লাহ মিয়া, অ্যাডভোকেট জাকির হোসেন, অ্যাডভোকেট আনিসুর রহমান রায়হান বিশ্বাস,অ্যাডভোকেট সামসুল ইসলাম মুকুল, আজমল হোসেন খোকন।
রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল অনীক আর হক, আব্দুল জব্বার ভূঁইয়া, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আবদুল্লাহ আল মাহমুদ মাসুদ।
মামলার আগের কার্যক্রম
গত বছরের ১ ডিসেম্বর তারেক রহমান ও লুৎফুজ্জামান বাবরসহ সব আসামিকে খালাস দেন হাইকোর্ট। বিচারিক আদালতের রায় বাতিল করে বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেন।
রায়ে আদালত বলেন, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার বিচার ছিল অবৈধ। আইনে এ বিচার টেকে না।
রায়ে বলা হয়, যে চার্জশিটের ভিত্তিতে নিম্ন আদালত বিচার করেছিলেন তা আইনগতভাবে গ্রহণযোগ্য ছিল না।
এরপর এ মামলায় সব আসামির খালাসের বিরুদ্ধে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। গত ১ জুন রাষ্ট্রপক্ষকে আপিলের অনুমতি দেন আপিল বিভাগ।
নিম্ন আদালতের রায়
২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ও হত্যা মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনকে ফাঁসি এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, বিএনপি নেতা কাজী শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন কায়কোবাদসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন বিচারিক আদালত।
নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১৯ আসামি
সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিম, হানিফ পরিবহনের মালিক মো. হানিফ, জঙ্গি নেতা মাওলানা তাজউদ্দীন, মাওলানা শেখ আবদুস সালাম, মাওলানা শেখ ফরিদ, মাওলানা আবু সাইদ, মুফতি মঈনউদ্দিন শেখ ওরফে আবু জান্দাল, হাফেজ আবু তাহের, মো. ইউসুফ ভাট ওরফে মাজেদ ভাট, আবদুল মালেক, মফিজুর রহমান ওরফে মহিবুল্লাহ, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, মো. জাহাঙ্গীর আলম, হোসাইন আহমেদ তামিম, রফিকুল ইসলাম ওরফে সবুজ ও মো. উজ্জ্বল ওরফে রতন।
যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ১৯ আসামি
শাহাদাৎ উল্লাহ ওরফে জুয়েল, মাওলানা আবদুর রউফ ওরফের আবু ওমর, আবু হোমাইরা ওরফে পীরসাহেব, মাওলানা সাব্বির আহমদ ওরফে আবদুল হান্নান সাব্বির, আরিফ হাসান ওরফে সুজন ওরফে আবদুর রাজ্জাক, হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া, আবু বকর ওরফে সেলিম হাওলাদার, মো. আরিফুল ইসলাম ওরফে আরিফ, মহিবুল মোত্তাকিন ওরফে মুত্তাকিন (পলাতক), আনিসুল মুরছালিন ওরফে মুরছালিন (পলাতক), মো. খলিল (পলাতক), জাহাঙ্গীর আলম বদর ওরফে ওস্তাদ জাহাঙ্গীর (পলাতক), মো. ইকবাল (পলাতক), লিটন ওরফে মাওলানা লিটন (পলাতক), তারেক রহমান ওরফে তারেক জিয়া (পলাতক), হারিছ চৌধুরী (পলাতক), কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ (পলাতক), মুফতি শফিকুর রহমান (পলাতক), মুফতি আবদুল হাই (পলাতক) এবং রাতুল আহম্মেদ বাবু ওরফে বাবু ওরফে রাতুল বাবু (পলাতক)।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বিকেলে আওয়ামী লীগের (কার্যক্রম নিষিদ্ধ) কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে দলটির সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। ওই হামলায় আওয়ামী লীগের মহিলা-বিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। আহত হন শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের কয়েকশ নেতা-কর্মী।
প্রকাশক ও সম্পাদকঃ অ্যাডভোকেট মোঃ শরীফ মিয়া
অফিস ঠিকানা: বাড়ি নং ১৫ (৬ষ্ঠ তলা), রোড নং ১৯, সেক্টর নং ১১, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০
somriddhabangladesh@gmail.com
Copyright © 2025 দৈনিক সমৃদ্ধ বাংলাদেশ. All rights reserved.