দৈনিক সমৃদ্ধ বাংলাদেশ
ঢাকাTuesday , 5 August 2025
  1. অর্থনীতি
  2. আইন-আদালত
  3. আন্তর্জাতিক
  4. আবহাওয়া
  5. খেলাধুলা
  6. জাতীয়
  7. তথ্যপ্রযুক্তি
  8. ধর্ম
  9. বিনোদন
  10. বিশেষ প্রতিবেদন
  11. রাজনীতি
  12. লাইফস্টাইল
  13. শিক্ষা
  14. সারাদেশ
  15. স্বাস্থ্য
আজকের সর্বশেষ সবখবর

এখনো হাসিনার পতনের সাক্ষী ঢাকার অলিগলির দেয়াল

বার্তা কক্ষ
August 5, 2025 10:05 am
Link Copied!

ঢাকার রাস্তার দেয়াল আজ শুধু আর ইট-সিমেন্ট আর কংক্রিটের তৈরি কোনো কাঠামো নয়। গত এক বছরে সেগুলো পরিণত হয়েছে ইতিহাসের আয়নায়। যেখানে রং-তুলির আঁচড়ে এখনো জীবন্ত প্রতিবাদের ভাষা, যেখানে ফুটে উঠেছে গণআন্দোলনের বেদনামিশ্রিত মহাকাব্য। ঢাকার অলিগলির দেয়ালগুলোতে আঁকা গ্রাফিতি মনে করিয়ে দিচ্ছে এক বছর আগের জুলাইয়ের সেই দিনগুলোর কথা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে শহরের অলিগলি, পাড়া-মহল্লার ছোট-বড় রাস্তা, সড়কের পাশের ভবন, স্থাপনার প্রতিটি দেয়াল যেন সাক্ষ্য দিচ্ছে এক অভূতপূর্ব সময়ের, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের রক্তাক্ত সংগ্রাম আর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের ইতিহাসের।

dhakapost

৫ আগস্টের আগে হয়তো কেউ কল্পনাও করেননি, সেটি ঘটিয়েছেন ছাত্র-জনতা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় সরকার পতনের এক দফা দাবিতে মাঠে নেমে আসেন লাখো ছাত্র-জনতা। জনতার সেই ঢেউ ভেঙে দেয় টানা ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা এক স্বৈরশাসকের দম্ভ। পতন হয় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের। সেদিন অগ্নিগর্ভ জনতা ভেঙে দেন স্বৈরাচারের আঁতুড়ঘর গণভবনের দেয়াল।

এরপর বদলে যেতে থাকে শহরের দেয়ালের চিত্র। কোটা আন্দোলনের স্লোগান থেকে গণঅভ্যুত্থানের প্রতীক— সবই ফুটে ওঠে স্কুল-কলেজপড়ুয়াদের আঁকা গ্রাফিতিতে। একেকটি দেয়াল হয়ে ওঠে একেকটি ক্যানভাস আর প্রতিটি আঁচড়ে লেখা হয় রক্তাক্ত জুলাইয়ের উপাখ্যান। রক্তাক্ত জুলাইয়ের এক বছর অতিবাহিত হয়েছে। তবে, এখনো ঢাকার দেয়ালে জীবন্ত সেই ইতিহাস, যা মনে করিয়ে দিচ্ছে আন্দোলনে দাবানলে পরিণত হওয়া সেসব দিনের কথা।

ঢাকায় দীর্ঘদিন ধরে সিএনজি চালান এরশাদ আলী। ঢাকার দেয়ালে থাকা নানা রকমের গ্রাফিতি ও লেখা নিয়ে কথা হয় তার সঙ্গে। সিএনজিতে চলতে চলতে তিনি বলেন, ছোটবেলা থেকেই ঢাকায় বসবাস। আর সিএনজি চালাই ২০ বছরের বেশি সময় ধরে। ঢাকা শহরে এত আন্দোলন-সংগ্রাম দেখেছি কিন্তু আন্দোলনের এমন অংশ…, পুরো ঢাকা শহরের অলিগলি রাঙিয়ে দেয়ালে দেয়ালে এমন লেখা, ছবি আঁকা কখনোই দেখিনি।

dhakapost

এরশাদ আলী বলেন, যাত্রাবাড়ী, মোহাম্মদপুর, উত্তরা, মিরপুর; ঢাকার এমন কোনো এলাকা নেই যেখানে আমাদের যাত্রী নিয়ে যেতে হয় না। সেই অভিজ্ঞতা থেকে নিশ্চিত করে বলতে পারি, এমন কোনো দেয়াল, এমন কোনো ভবন নেই যেখানে রঙ দিয়ে রাঙিয়ে প্রতিবাদের স্লোগান লেখা হয়নি। যাত্রী নিয়ে সিএনজি চালানোর সময় ডানে-বামে যেদিকেই তাকাই সেদিকেই দেখি এমন সব লেখা, এমন সব ছবি আঁকা। যেখানে চোখ পড়লেই মনে পড়ে গত বছর সেই দিনগুলোতে ঢাকায় কী হয়েছিল।

জুলাইয়ের সংগ্রাম যখন চলছে সেই দিনগুলোতে ঘোষণা আসে এক অভিনব কর্মসূচির— গ্রাফিতি আঁকা। হাতে রঙ-তুলি নিয়ে এগিয়ে আসেন তরুণ-তরুণীরা। স্কুল-কলেজের এসব শিক্ষার্থী নিজেদের পকেটের টাকায় কিনে আনেন রঙ, পরিষ্কার করেন দেয়াল, তারপর আঁকেন ইতিহাস। কয়েকদিনের মধ্যে দেশের দেয়ালজুড়ে সৃষ্টি হয় এমন শিল্পকর্ম, যা পৃথিবীর ইতিহাসেও বিরল। বাংলাদেশে আগে কোনো আন্দোলন এত অল্প সময়ে এত বিপুল গ্রাফিতির জন্ম দেয়নি।

প্রতিটি গ্রাফিতি যেন একেকটি মহাকাব্য। কোথাও আঁকা, কোথাও বা লেখা— ‘বুকের ভিতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর’, ‘তোর কোটা তুই নে, আমার ভাইকে ফেরত দে’, ‘ছিনিয়ে এনেছি বিজয়, শিখিনি পরাজয়’, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো জুলাই’, ‘নাটক কম করো পিও’, ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা ৩৬ শে জুলাই’, ‘পানি লাগবে পানি’, ‘গর্জে উঠেছিলাম বলেই বাংলাদেশে…’। এমন সব গ্রাফিতিতে ও অঙ্কনে ভরে ওঠে ঢাকার অলিগলি, ভবনের দেয়াল, সড়কদ্বীপ, মেট্রোরেল বা উড়াল সড়কের স্তম্ভও।

dhakapost

রাজধানীর রামপুরা এলাকায় কথা হয় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল মামুনের সঙ্গে। তিনি বলেন, পুরো ঢাকা শহরের অলিগলি, মূল সড়কের প্রতিটি দেয়ালে আজও রয়ে গেছে জুলাই-আগস্টের সেই চিহ্নগুলো। প্রতিটি দেয়ালে গ্রাফিতি আঁকা আছে, আছে স্লোগান লেখা। ঢাকা শহরে চলতে গেলে যে কারো চোখ সেখানে পড়বেই আর মনে পড়ে যাবে গত বছরের জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের কথা। আমরা আন্দোলনের সময় নিজেদের মধ্য থেকে টাকা তুলে দেয়ালে গ্রাফিতি করেছি। সেই সব গ্রাফিতি দেখলে যে কারোরই এখন সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যাবে।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এসব গ্রাফিতিতে শুধু স্লোগান নয়, জেগে উঠেছে প্রতিরোধের ভাষাও। সাহসিকতার প্রতীক আবু সাঈদ– দুই হাত প্রসারিত করে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা তার অগণিত প্রতিকৃতিতে ছেয়ে গেছে শহরের দেয়াল। আছে মুগ্ধের প্রতিকৃতিও, আছে তার পানির বোতল হাতে আঁকা প্রতীকী ছবি।

এসব দেয়াল লিখন, গ্রাফিতি দেখে যে কারো মনে হতে পারে, আজকের ঢাকা যেন রক্তাক্ত জুলাইয়ের এক চলমান প্রদর্শনী। যেখান প্রতিটি দেয়াল সাক্ষ্য দিচ্ছে, কীভাবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নিয়েছে। এতে লেখা হয়েছে এক নতুন বাংলাদেশের কথা, যেখানে উঠে এসেছে  অসাম্প্রদায়িকতার শপথ, দুর্নীতি-অত্যাচারের অবসান আর পরবর্তী প্রজন্মের স্বপ্ন। দেয়ালের এসব ভাষা বলে দেয়— বাংলাদেশ শুধু পতনের গল্প লেখেনি, গড়েছে পুনর্জাগরণের ইতিহাস।

dhakapost

এদিকে, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) সার্বিক সহযোগিতায় আগারগাঁও থেকে কারওয়ান বাজার মেট্রোরেল পিলারের অঙ্কিত গ্রাফিতি ‘জুলাই আর্ট ওয়ার্কের’ আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়েছে।

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ‘দেয়ালের ভাষা : স্মৃতি, প্রতিরোধ ও জনতার ইতিহাস’ প্রতিপাদ্য সামনে রেখে অঙ্কিত জুলাই আর্ট ওয়ার্কে ২০২৪ সালের ঐতিহাসিক জুলাই ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান এবং ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রতিরোধের এক শক্তিশালী চিত্রমালা উপস্থাপন করা হয়েছে।

dhakapost

ডিএনসিসির আঁকা দেয়াল চিত্রগুলোর মাধ্যমে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনৈতিক দমন-পীড়নের ভয়াবহ অধ্যায় এবং ২০২৪ সালের ৩৬ দিনের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের নানা দৃশ্য– মিছিল, সংঘর্ষ, গ্রেপ্তার, আত্মত্যাগ উপস্থাপিত হয়েছে। গুম, হত্যা, ভোট ডাকাতি, শিক্ষাব্যবস্থার ধ্বংস ও নাগরিক অধিকারের হরণ– এসব বাস্তবতার প্রতিবিম্ব ফুটে উঠেছে রং ও রেখার প্রতিটি আঁচড়ে।

এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বলেন, ফ্যাসিবাদ ইস্যুতে জাতীয় ঐক্য ধরে রাখার বিষয়টি মাথায় রেখেই এই গ্রাফিতি কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। গত ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনের উত্থান এবং তার পতনের ইতিহাস তুলে ধরাই ছিল এ আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য। গত এক বছরে অনেক রং ফিকে হয়ে গেলেও জুলাইয়ের চেতনা আজও অমলিন।