দেশের প্রায় চার কোটি মানুষ বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের মধ্যে রয়েছে। প্রায় ২৪ শতাংশ বা প্রতি চারজনের মধ্যে একজন মানুষ বসবাস করছে বহুমাত্রিক দারিদ্র্যে। এ ধরনের দারিদ্র্যের হার শহরের তুলনায় গ্রামে প্রায় দ্বিগুণ। প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় শিশুদের মধ্যে বেশি। সবচেয়ে বেশি সিলেট বিভাগে। আর জেলাভিত্তিক হিসাবে সবচেয়ে বেশি বান্দরবানে।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি) প্রকাশিত ‘ন্যাশনাল মাল্টিডাইমেনশনাল পভার্টি ইনডেক্স (এমপিআই) ফর বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে পরিকল্পনা কমিশনের এনইসি সম্মেলন কক্ষে এক সেমিনারে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশের বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের ওপর এটিই প্রথম কোনো প্রতিবেদন।
সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী। জিইডির সদস্য ড. মনজুর হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান, বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. এ কে এনামুল হক, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব আলেয়া আখতার, ইউনিসেফের প্রতিনিধি রানা ফ্লাওয়ার্স, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ডেলিগেশনের প্রথম কাউন্সিলর এডউইন কুককোক প্রমুখ।
বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক কী
বিশ্বের দারিদ্র্য পরিমাপের বিভিন্ন পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে। বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও দারিদ্র্য পরিমাপে মৌলিক চাহিদার ব্যয়ভিত্তিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা আয় ও ব্যয় জরিপে অর্থমূল্যভিত্তিক দারিদ্র্যের এই হিসাব পাওয়া যায়। কিন্তু জাতিসংঘ ও অর্থনীতিবিদদের মতে, এ ধরনের পদ্ধতিতে দারিদ্র্যের সব দিক ও মানুষের দৈনন্দিন জীবনের বঞ্চনার প্রকৃত চিত্র ওঠে আসে না। তাই দারিদ্র্য-বঞ্চনার বিভিন্ন বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ দিতে বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক অনুসরণ করতে বলা হয়েছে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টে (এসডিজি)।
জিইডির বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক (এমপিআই) প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করা হয়েছে ২০১৯ সালের বিবিএস মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভের (এমআইসিএস) তথ্যের ভিত্তিতে। এতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং জীবনযাত্রার মানের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো বিশ্লেষণ করে বহুমাত্রিক দারিদ্র্য পরিস্থিতি দেখা হয়েছে। এ জন্য বিবিএস, ইউনিসেফ, অক্সফোর্ড মাল্টিডাইমেনশনাল পভার্টি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ এবং বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতা নিয়েছে জিইডি।
দেশে বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের চিত্র
এমপিআই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ৩ কোটি ৯৮ লাখ মানুষ বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের মধ্যে আছে। মোট জনসংখ্যার ২৪ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ মানুষ বহুমাত্রিকভাবে দরিদ্র। উল্লেখ্য, বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের এ হার সাধারণ দারিদ্র্যের হারের চেয়ে বেশ খানিকটা বেশি। বিবিএসের সর্বশেষ খানা আয় ও ব্যয় জরিপে (২০২২) দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ।
জিইডির প্রতিবেদনে দেখা যায়, গ্রাম এলাকায় বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের হার শহরাঞ্চলের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। গ্রামাঞ্চলে এ হার ২৬ দশমিক ৯৬ শতাংশ। অন্যদিকে শহরাঞ্চলে ১৩ দশমিক ৪৮ শতাংশ। শিশুদের মধ্যে এ হার ২৮ দশমিক ৭০ শতাংশ। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ২১ দশমিক ৪৪ শতাংশ।
বিভাগ ও জেলাভিত্তিক হার
এমপিআই প্রতিবেদনে অনুসারে, বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের হার সবচেয়ে বেশি সিলেট বিভাগে। এ বিভাগে ৩৭ দশমিক ৭০ শতাংশ। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ময়মনসিংহ বিভাগ। বিভাগটির ৩৪ দশমিক ৯৫ শতাংশ মানুষ বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের মধ্যে রয়েছে। তৃতীয় অবস্থানে থাকা বরিশাল বিভাগে এ হার ৩১ দশমিক ৫৭ শতাংশ।
এর পরের অবস্থানে থাকা বিভাগগুলোতে বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের হার যথাক্রমে চট্টগ্রাম ২৭ দশমিক ২৪, রংপুর ২৫ দশমিক শূন্য ৪, রাজশাহী ২২ দশমিক ২৬, ঢাকা ১৬ দশমিক ৯৫ ও খুলনা ১৫ দশমিক ২২ শতাংশ। তবে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি চট্টগ্রাম বিভাগে। এ বিভাগের প্রায় ৯০ লাখ মানুষ বহুমাত্রিক দরিদ্র্য। সংখ্যার হিসাবে দ্বিতীয় স্থানে থাকা ঢাকা বিভাগে বহুমাত্রিক দরিদ্র মানুষ ৭৫ লাখের বেশি।
জেলাভিত্তিক হিসাবে বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের হার সবেচেয়ে বেশি বান্দরবানে। এ জেলার ৬৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ মানুষ বহুমাত্রিকভাবে দরিদ্র। শীর্ষ তিনে থাকা অন্য দুই জেলা হচ্ছে– কক্সবাজার (৪৭.৭০%) ও সুনামগঞ্জ (৪৭.৩৬%)।
অন্যদিকে সবচেয়ে কম বহুমাত্রিক দারিদ্র্য লক্ষ্য করা গেছে ঝিনাইদহ জেলায়। এ জেলার ৮ দশমিক ৬৬ শতাংশ মানুষ বহুমাত্রিক দরিদ্র। এ ছাড়াও কম বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের হার থাকা অন্য জেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে ঢাকা (৯.১৯%), গাজীপুর ( ৯.৬৩%) ও যশোর (১০.৫৮%)।
বঞ্চনা বেশি কোন খাতে
এমপিআই প্রতিবেদনে মানুষের বঞ্চনার একটি চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে। এতে কোনো একটি নির্দিষ্ট সূচকে কত শতাংশ মানুষ বঞ্চিত, দারিদ্র্যের অবস্থান নির্বিশেষে তা প্রকাশ করা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি বঞ্চনা দেখা গেছে আবাসন, ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ, স্যানিটেশন ও সম্পদের ক্ষেত্রে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ৬১ দশমিক ৭৯ শতাংশ মানুষ বাড়ির মেঝে, দেয়াল বা ছাদের যে কোনো একটির ক্ষেত্রে উন্নত সুবিধা থেকে বঞ্চিত। ৫৯ দশমিক ২৭ শতাংশ মানুষ ইন্টারনেট সুবিধা থেকে বঞ্চিত। উন্নত স্যানিটেশন সুবিধা পায় না ৫৭ দশমিক ২২ শতাংশ মানুষ। ৪৪ দশমিক ৮৯ শতাংশ মানুষের ন্যূনতম সম্পদ নেই। কিছু সূচকে বঞ্চনার হার তুলনামূলকভাবে কম। যেমন– ৫ শতাংশ মানুষ প্রজনন স্বাস্থ্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত, বিদ্যুৎ সুবিধা পায় না ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ মানুষ।