যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত ৩৫ শতাংশ শুল্ক কমাতে দেশটি থেকে বিভিন্ন পণ্যে আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ। এক সময় সাহায্য হিসেবে গম আসতো, সেটিও বাড়তি দামে কিনতে চায় ঢাকা। এরই মধ্যে বোয়িংয়ের ২৫টি উড়োজাহাজ কিনতে প্রাথমিক অর্ডার দেওয়া হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে আশা করা হচ্ছে আরও কিছু পণ্য আমদানির মাধ্যমে বাণিজ্য ঘাটতি কমানো গেলে শুল্ক হারও কমতে পারে। কিন্তু সেটা কতটা?
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি প্রায় ৬০০ কোটি ডলার। সবশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে মোট ৮৭০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। বিপরীতে আমদানি হয়েছে ২৭০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ পণ্য। সরকার আশা করছে, প্রতিযোগী দেশগুলোর চেয়ে বাংলাদেশের ওপর পাল্টা শুল্ক কম হবে। কেননা, ট্রাম্পের মূল লক্ষ্য বাণিজ্য ঘাটতি কমানো।
স্থানীয় সময় মঙ্গলবার ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করবে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল। এতে অংশ নেওয়ার আগে গতকাল সোমবার বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান সমকালকে বলেন, বাংলাদেশ নতুন করে যে পরিমাণ আমদানির পরিকল্পনা করছে, তাতে আমদানি এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে তিন বিলিয়ন ডলার বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইউএসটিআরের সঙ্গে আলোচনায় আগামীতে দেড় বিলিয়ন ডলার আমদানি বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হবে।
বাড়তি দামে সাহায্যের গম কেনা
যুক্তরাষ্ট্র থেকে এতদিন গম আসতো সাহায্য হিসেবে। তবে সম্প্রতি ২ লাখ ২০ হাজার টন গম আমদানির অনুমোদন দিয়েছে সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটি। এ নিয়ে ইউএস হুইট সমিতির সঙ্গে সমঝোতা স্মারকও সই হয়েছে। প্রতি মেট্রিক টন গম কিনতে ব্যয় হবে ৩০২ দশমিক ৭৫ মার্কিন ডলার। সে হিসাবে ২ লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টন গম কিনতে ব্যয় হবে ৮১৭ কোটি ৫৭ লাখ ৬৩ হাজার টাকা।
অর্থ উপদেষ্টা নিজেই বলেছেন, এ গম কেনা হবে বাড়তি দামে। ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, এ গমে প্রোটিনের হার কিছুটা বেশি। তাই দামও কিছুটা বেশি পড়বে। তবে তিন উদ্দেশ্যে এ গম কেনা হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে আছে, শুল্ক ইস্যুতে দর-কষাকষিতে সহায়তা পাওয়া। একই সঙ্গে আমদানির উৎস বাড়ানো।
পোশাকসহ নকল পণ্য কমানো
শুল্ক নিয়ে দরকষাকষিতে মেধাস্বত্ব অধিকারকে (আইপিআর) শক্তিশালী ও কার্যকর করার বিষয়ে জোর দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন বাণিজ্য দপ্তরের (ইউএসটিআর) ২০২৪ ও ২০২৫-এর বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী নকল পোশাক তৈরির শীর্ষ পাঁচটি উৎসের একটি বাংলাদেশ। এতে মার্কিন শ্রমিকসহ বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বলে দাবি করেছে দেশটি। তাই দরকষাকষিতে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে মেধাস্বত্ব অধিকারকে শর্ত হিসেবে যোগ করা হয়েছে।
বাংলাদেশে নকল পণ্য তৈরির ফলে কীভাবে তাদের শ্রমিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তাও জানিয়েছে ওয়াশিংটন। বাংলাদেশে যত কম্পিউটার চলে, তাতে যে অপারেটিং সিস্টেম বা সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয়, এর ৯৯ শতাংশ নকল। এ অপারেটিং সিস্টেম বা সফটওয়্যারগুলো যদি আসল ব্যবহার করতে হতো, তাহলে বাংলাদেশে কম্পিউটারের দাম অনেক বেশি পড়ত। আসল পণ্য হলে মার্কিন অর্থনীতিতে তা অবদান রাখবে।
চীনের প্রতি ঝোঁক কমানো
কেবল বাণিজ্য নয়, বৃহত্তর কৌশলগত ক্ষেত্রেও ঢাকার সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে চায় ওয়াশিংটন। যেটির মূল উদ্দেশ্য বাংলাদেশ যেন চীনের দিকে অতিরিক্ত না ঝোঁকে। পাশাপাশি ঢাকা যাতে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় আঞ্চলিক কৌশলের (আইপিএস) পক্ষে থাকে সেটিও চায় যুক্তরাষ্ট্র।
আইপিএস হলো যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিস্তৃত কৌশল। এর লক্ষ্য হচ্ছে পুরো অঞ্চলে অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সহযোগিতা জোরদার করে চীনের প্রভাব মোকাবিলা করা। শুল্ক আলোচনার সময় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে চীনের বাড়তে থাকা ব্যবসা-বিনিয়োগ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। দেশটি চায়, বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ উৎসাহিত না করুক।
যুক্তরাষ্ট্র যদি কোনো দেশকে নিষেধাজ্ঞা দেয়, তবে বাংলাদেশকেও তা মেনে চলতে হবে। অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া দেশের সঙ্গে বাংলাদেশকেও ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগসংক্রান্ত কার্যক্রম থেকে বিরত থাকতে হবে। এ ছাড়া, যেসব মার্কিন পণ্যকে বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত সুবিধা দেবে, সেগুলো অন্য কোনো দেশকে না দেওয়ার শর্ত রয়েছে।
বোয়িংয়ের ২৫ উড়োজাহাজ
শুল্ক কমানোর দর-কষাকষিতে সুবিধা পেতে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক উড়োজাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বোয়িংয়ের ২৫টি উড়োজাহাজ কেনার অর্ডার দিয়েছে বাংলাদেশ। বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান বলেছেন, এই পরিকল্পনা সরকারের আগে থেকেই ছিল। বাংলাদেশ বিমানের বহর বাড়াতে হবে। আগে ১৪টি বোয়িংয়ের অর্ডার ছিল, পাল্টা শুল্ক ইস্যুতে ২৫টি করা হয়েছে।
সবশেষ এয়ার ইন্ডিয়ার একটি ফ্লাইট বিধ্বস্ত হওয়ার পর বোয়িংয়ের উড়োজাহাজ নিয়ে জনমতে আতঙ্ক দেখা দেয়। এভিয়েশন সেফটি নেটওয়ার্কের ডেটাবেসে চলতি বছর বোয়িংয়ের বিভিন্ন মডেলের উড়োজাহাজের ২৩টি দুর্ঘটনার তথ্য পাওয়া গেছে।
আরও পণ্য ও শুল্কমুক্ত সুবিধা
যুক্তরাষ্ট্র পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণার পরই ডোনাল্ড ট্রাম্পকে চিঠি লিখেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। এতে বড় আকারে আমদানি বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেয় বাংলাদেশ। চিঠিতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানিতে কয়েক বছরের চুক্তির আগ্রহের কথা বলা হয়। প্রধান বিষয় হবে কৃষিপণ্য বিশেষ করে তুলা, গম, ভুট্টা ও সয়াবিন আমদানি উল্লেখযোগ্য অঙ্কে বাড়ানো; যা যুক্তরাষ্ট্রের কৃষকদের আয় ও জীবিকার ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এ ছাড়া গ্যাস টারবাইন, সেমিকন্ডাক্টর ও মেডিকেল ইকুইপমেন্টসহ প্রধান প্রধান পণ্যে শুল্ক ৫০ শতাংশ কমানোর কাজ চলছে বলেও উল্লেখ করা হয়।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রকে ১৯০টি পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয় বাংলাদেশ। সম্প্রতি ইউএসটিআর অ্যাম্বাসাডর জামিসন গ্রিয়ারকে লেখা চিঠিতে বাণিজ্য উপদেষ্টা উল্লেখ করেন, আরও ১০০ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনাধীন।
শুল্ক কতটা কমবে
পোশাক রপ্তানি বাজারে বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনাম এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি করেছে। এর মাধ্যমে দেশটির ওপর আরোপিত শুল্ক ৪৬ থেকে কমে ২০ এ নেমেছে। তারা যুক্তরাষ্ট্রকে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছে। ৯৯ শতাংশ পণ্যে শুল্ক প্রত্যাহারে রাজি হওয়ায় ইন্দোনেশিয়ার ট্যারিফ ১৩ শতাংশ কমেছে। জাপানের কমেছে ১০ শতাংশ।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আলোচনা এখনো চলমান। শেষ মুহুর্তের আলোচনা শুরু হচ্ছে আজ মঙ্গলবার থেকে। তবে গত ২৩ জুলাই সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির বৈঠক শেষে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেছিলেন, স্পষ্ট ইঙ্গিত না পাওয়া গেলেও আশা করা হচ্ছে সম্পূরক শুল্ক কিছুটা কমবে।
প্রকাশক ও সম্পাদকঃ অ্যাডভোকেট মোঃ শরীফ মিয়া
অফিস ঠিকানা: বাড়ি নং ১৫ (৬ষ্ঠ তলা), রোড নং ১৯, সেক্টর নং ১১, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০
somriddhabangladesh@gmail.com
Copyright © 2025 দৈনিক সমৃদ্ধ বাংলাদেশ. All rights reserved.