উত্তরায় যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের পাঁচ দিন পেরিয়ে গেলেও সেই দুর্বিষহ স্মৃতি তাড়া করে ফিরছে দগ্ধদের। এখনও অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ পেলে কান্নাকাটি শুরু করে আহত শিশুরা। তাদেরই একজন ১১ বছরের শিশু নূরে জান্নাতি ইউশা। সে রাজধানীর জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের ৫২০ নম্বর কক্ষে চিকিৎসাধীন। তার শরীরের ১১ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। কিন্তু দিয়াবাড়ীর বাসায় আর ফিরতে চায় না শিশুটি।
গতকাল শুক্রবার জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটের পাঁচতলায় গিয়ে কথা হয় মাইলস্টোন স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী ইউশার বাবা ব্যবসায়ী জসিম উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এই কয়টা দিন আমাদের এখানেই কেটেছে। যা কিছুর বিনিময়ে হোক না, মেয়েকে সুস্থ করে তুলতে চাই। ২৪ ঘণ্টা ওর কাছে আছি। ইউশাকে বাসায় যাওয়ার কথা বললেই সে আর দিয়াবাড়ীর বাসায় যাবে না বলে কান্নাকাটি শুরু করে। মেয়ের জন্য আমি বাসা কেন, ওই এলাকা ছাড়তে রাজি আছি। আল্লাহ শুধু আমার মেয়েকে ফিরিয়ে দিন।’
গত ২১ জুলাই রাজধানীর উত্তরা মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ওপরে বিধ্বস্ত হয় বাংলাদেশ বিমানের যুদ্ধবিমান। এতে এখন পর্যন্ত ৩৩ জনের মৃত্যুর কথা জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। চিকিৎসাধীন শিশুসহ আরও ৫০ জন।
দগ্ধ ইউশার মা ইয়াসমিন আক্তার বলেন, ‘মেয়েটার অবস্থা বেশি ভালো না। এই ধাক্কা কুলিয়ে উঠলেও তার মানসিক অবস্থা নিয়ে খুবই চিন্তিত। সারারাত ওর মাথার পাশে বসে থাকতে হয়। অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ বা ওয়ার্ডের মধ্যে কারও পায়ের আওয়াজ পেলেও ঘুমের মধ্যে কান্নাকাটি করছে। এ ছাড়া সে বলছে, দিয়াবাড়ীর বাসায় আর যাবে না। টঙ্গীতে নানাবাড়ি এবং মিরপুরে দাদাবাড়ি যাবে, কিন্তু নিজেদের বাসায় আর যাবে না। এতটাই ট্রমার মধ্যে চলে গেছে বাচ্চাগুলো।’
ঘটনার দিনের কথা স্মরণ করে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘বড় ছেলে তাহসিন ইকরাম রুহানও মাইলস্টোন স্কুলে দশম শ্রেণির ছাত্র। ওরা দুই ভাইবোন একসঙ্গে যাওয়া-আসা করে।
বিকট শব্দের পর ইউশার ক্লাসকক্ষে ছুটে যায় রুহান। সেখান থেকে বোনকে কোলে তুলে নিয়ে বেরিয়ে আসে। পরে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে ওর বাবাকে ফোন করে ঘটনা জানায়। তারপরও ইউশার দুই হাত ও মুখমণ্ডলের কিছু অংশ পুড়ে গেছে।’
জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে কঠোর নিরাপত্তায় বিমান দুর্ঘটনায় আহতদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ইনস্টিটিউটে জরুরি বিভাগ ও প্রধান প্রবেশদ্বারে সেনা, বিমানবাহিনীসহ পুলিশ ও আনসার সদস্যরা নিরাপত্তায় কাজ করছেন। রোগীর স্বজন ছাড়া কাউকে হাসপাতালের ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না।
বার্ন ইনস্টিটিউটে বিদেশি চিকিৎসক দল
ঘটনার পরদিন রাতেই সিঙ্গাপুর থেকে পাঁচ সদস্যের একটি চিকিৎসক প্রতিনিধি দল ঢাকায় আসে। তাদের সঙ্গে সমন্বয় করে এখন চিকিৎসা দেওয়া হয়। গত বৃহস্পতিবার আসেন ভারত ও চীনের চিকিৎসক প্রতিনিধি দল। গতকাল তারা জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে আসেন।
এ বিষয়ে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসির উদ্দিন বলেন, বিমান দুর্ঘটনায় চিকিৎসায় সহায়তা করতে সিঙ্গাপুর, চীন ও ভারত থেকে প্রতিনিধি দল ঢাকায় আসছে। তাদের সমন্বয়ে আহতদের চিকিৎসা দিচ্ছেন চিকিৎসরা।
চার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অর্ধশত
বিমান দুর্ঘটনায় রাজধানীর চারটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ৫০ জন। এর মধ্যে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে ৪০ জন। তাদের মধ্যে ৮ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এ ছাড়া সিএমএইচে আট, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল এবং শহীদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একজন করে চিকিৎসাধীন।
এদিকে গতকাল জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন আরও দুই শিশু মারা গেছে। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে মাইলস্টোন স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী তাসনিম আফরোজা আইমান (১০) মারা যায়। এর ঘণ্টা তিনেক পর একই স্কুলের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী আব্দুল মুসাব্বির মাকিনের (১৩) মৃত্যুর খবর আসে। এ নিয়ে দুর্ঘটনায় ৩৩ জনের মৃত্যু হলো। নিহতদের মধ্যে ২৫ জন শিক্ষার্থী।
গতকাল বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে বার্ন ইনস্টিটিউটের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক বলেন, ‘এই মুহূর্তে বার্ন ইনস্টিটিউটে পাঁচজন ক্রিটিক্যাল রোগীর পাশাপাশি সিভিয়ার গ্রুপে আছেন ১০ জন। আর ইন্টারমিডিয়েট পর্যায়ে ২৫ জন। এই ২৫ জনের মধ্যে ১৫ জনকে কেবিনে শিফট করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, একটি ভালো খবর হলো, যারা ভেন্টিলেশনে রয়েছেন তাদের মধ্যে দুজন সজাগ আছেন এবং নিজেরা নিঃশ্বাস নিতে পারছেন। শনিবার ৪-৫ জনকে ছুটি দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
এদিকে মাইলস্টোন স্কুলের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে তাদের প্রতিষ্ঠানের ৩১ জন নিহত হওয়ার তথ্য জানানো হয়েছে। এর মধ্যে শিক্ষার্থী ২৫ জন, শিক্ষক দুইজন এবং অভিভাবক চারজন। এ ঘটনায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ৫০ জন। এর মধ্যে ৩৯ জন শিক্ষার্থী, সাতজন শিক্ষক, একজন অভিভাবক, দুইজন আয়া ও একজন অফিস সহকারী।
দাফন ও শ্রদ্ধা নিবেদন
গতকাল সকাল ৮টায় জানাজা শেষে মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার জয়পুর গ্রামে মাহিয়া তাসনিম মায়া এবং সকাল ৯টার দিকে ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা উপজেলার বাজড়া শামসুল উলুম মাদ্রাসা ও এতিমখানায় রাইসা মনির দাফন সম্পন্ন হয়েছে।
এদিকে শুক্রবার বাদ জুমা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার সোহাগপুরে কেন্দ্রীয় কবরস্থানে মাইলস্টোন স্কুলের শিক্ষিকা মাসুকা বেগম নিপুর কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও শ্রদ্ধা নিবেদন করে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী। স্কোয়াড্রন লিডার মসিউর রহমানের নেতৃত্বে শিক্ষিকার সম্মানে গার্ড অব অনার প্রদান করে ১০ সদস্যের দল। পরে তারা নিহতের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সমবেদনা জানান।
এ ছাড়া গতকাল সোহাগপুরে শিক্ষিকা মাসুকা বেগমের কবর জিয়ারত করেন কেন্দ্রীয়, জেলা ও উপজেলা বিএনপির নেতাকর্মীরা। এ সময় তারা মাসুকার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে শোক ও সমবেদনা জানান। দুর্ঘটনার তদন্ত দাবি করেন বিএনপি নেতা শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানী।
প্রকাশক ও সম্পাদকঃ অ্যাডভোকেট মোঃ শরীফ মিয়া
অফিস ঠিকানা: বাড়ি নং ১৫ (৬ষ্ঠ তলা), রোড নং ১৯, সেক্টর নং ১১, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০
somriddhabangladesh@gmail.com
Copyright © 2025 দৈনিক সমৃদ্ধ বাংলাদেশ. All rights reserved.