সোয়াইবার বয়স ১৪ মাস পেরিয়েছে। বুলি ফোটার আগেই সে নীরবতা শিখেছে; হাঁটতে পারার আগেই বইছে জীবনের ভার! সোয়াইবার সবচেয়ে নিরাপদ মায়ের বুকটাই হারিয়ে গেছে গত বছরের ২০ জুলাই।
ছাত্র-জনতার আন্দোলন দেখতে বারান্দায় গেলে মাথায় গুলি লেগে মারা যান সোয়াইবার মা সুমাইয়া আক্তার (২০)। রাজধানীর চিটাগং রোডের ভাড়া বাসায় মা আসমা খাতুনের সঙ্গে থাকতেন তিনি।
এখন নানির কোলেই বড় হচ্ছে সোয়াইবা। বাবা থেকেও নেই। স্ত্রীর মৃত্যুর পর সন্তানের কোনো খোঁজ নেন না জাহিদ হোসেন। মেয়ের শোক বুকে চেপে তার রেখে যাওয়া সোয়াইবাকে ঘিরে নতুন জগৎ তৈরি হয়েছে আসমা খাতুনের।
আসমা খাতুন বলেন, ‘আমার বুকে যেন পাথর বসে আছে! মেয়েকে হারিয়েছি। তার ছোট্ট মেয়েও কোলে নিয়েছি। কিন্তু আমি তো তার মা নই। মা-ই তো আদর দিতে পারে; বুকের গন্ধে বড় করতে পারে। সোয়াইবা প্রায় মাঝরাতে কাঁদে, বুকের ওপর মুখ গুঁজে মাকে খোঁজে। আমি তো মায়ের স্পর্শ দিতে পারি না। আবার সইতেও পারি না।’
কণ্ঠ ধরে এলেও চোখের কোণে জমে থাকা পানি আটকাতে পারেননি আসমা। নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন, ‘আপনাদের মাধ্যমে অনুরোধ– আমার নাতনিটার জন্য সরকার যেন কিছু করে। ওর যেন একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ হয়।’
এক বছরেও জুলাই অভ্যুত্থানে নিহতদের পরিবারের সদস্যদের ক্ষত শুকায়নি। থামেনি কান্না। সরকারি তথ্যে, আন্দোলন চলাকালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীর হামলায় সুমাইয়াসহ ১১ নারী-শিশু নিহত এবং অন্তত ১৩২ শিশু-কিশোর আহত হন।
রিয়া গোপ, মেঘলা আকাশের নিচে নিভে যাওয়া হাসি নারায়ণগঞ্জের নয়ামাটির নিজের বাড়ির ছাদে গত বছরের ১৯ জুলাই বিকেলে খেলছিল ছয় বছরের রিয়া গোপ। বাইরে থেমে থেমে গুলির শব্দ, আতঙ্কে মেয়েকে আনতে ছাদে যান বাবা দীপক গোপ। কোলে নিতেই একটি গুলি এসে রিয়ার মাথায় বিঁধে। বাবার বুকেই নিথর হয়ে যায় রিয়া। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করলে ২৪ জুলাই সে মারা যায়।
এখনও রিয়ার মা বিউটি ঘোষ ঘর থেকে বের হন না। কারও সঙ্গে তেমন কথা বলেন না। চোখের জলে দিন শুরু করে ঘুমাতে যান কষ্টের অন্ধকারে। বাবা দীপক বলেন, ‘আমাদের বেঁচে থাকাটা বোঝা মনে হয়। মেয়েকে কোলে নিতে পারব না– এ সত্যটা এতদিনেও মানতে পারছি না।’
এসএসসির ফলাফলে নাঈমার মায়ের কান্না থামছে না
২৫ জুলাই ১৮ বছরে পা দিতেন নাঈমা সুলতানা। দিনটিতে এবার পরিবার কেক কাটবে না, গাইবে না জন্মদিনের গান। বরং চোখে জল আর বুকভরা শূন্যতা নিয়ে পালন করবে নাঈমার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। গত বছরের জুলাইয়ে আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলিতে নিহত হন উত্তরা মাইলস্টোন স্কুলের ১০ম শ্রেণির মেধাবী ছাত্রী নাঈমা। আন্দোলনের সময় ১৮ জুলাই বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে মোবাইলে ভিডিও করছিলেন, একটি গুলি এসে সব শেষ করে দেয়।
মুখ থেকে ঝরে পড়া শেষ শব্দ ছিল ‘মা’। আজও সেই শব্দ সারাক্ষণ আইনুন নাহারের কানে বাজে। চোখ ঝাপসা করে তিনি বললেন, ‘আজ আমার মেয়ের এসএসসির ফল দেওয়ার কথা ছিল। হয়তো সে খুশিতে লাফিয়ে বলত– মা, আমি গোল্ডেন পেয়েছি। অথচ আমার নাঈমা নেই।’ কথা শেষ হয় না আইনুন নাহারের। শিশুর মতো কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন, ‘বুকের ভেতরটা প্রতিদিন জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যায়। কয়েক দিন ধরে ভীষণ করে মেয়েটাকে ছুতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু বৃষ্টির কারণে যেতে পারিনি। আজই (বৃহস্পতিবার) গেছি, এসএসসির রেজাল্টের দিন। মতলবে তার কবরের পাশে একটু বসে থেকেছি। শুধু বলতে পেরেছি– তুই খুব ভালোবাসার মেয়ে ছিলি, মা।’
নাঈমার ১৫ মাসের বড় বোন তাসফিয়া সুলতানা এখনও সামলে উঠতে পারেনি। বোনের স্পর্শ লেগে থাকা ভাড়া বাসাটি ছাড়তে চান না। ফ্ল্যাটটি কিনে নিতে মা-বাবাকে অনুরোধ করেছেন।
তাসফিয়া বলছিলেন, ‘এই ফ্ল্যাটে আমার বোনের ঘ্রাণ মিশে আছে। আমি জানি, সে নেই, তবুও প্রতিদিন মনে হয়, বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমাকে ডাকছে, ঘরের আয়নায় নিজের চুল গুছিয়ে নিচ্ছে। কোথায় যাব আমি এসব ছেড়ে?’
জাবির ছাড়া আমরা অসহায়
জাবির ইব্রাহিমকে হারিয়ে পরিবারের ১১ সদস্যই মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। মা রোকেয়া বেগম স্বাভাবিক হতে পারেননি। বাবা কবির হোসেন আদরের ধন হারানোর পর কর্মস্থলে সহকর্মীদের সমন্বয়হীনতা বুঝতে পেরে চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছেন। অশ্রুসিক্ত নয়নে রোকেয়া বললেন, ‘জাবির আমাদের প্রাণ ছিল। প্রাণপাখি চলে গেছে, আমরা কী করে ভালো থাকি?’ তিনি বলেন, ‘জাবির মৃত্যুর আগ মুহূর্তেও বাবার কোলেই ছিল। তিনি কোনোভাবেই এটি মেনে নিতে পারছেন না।’
শুভর তিন বোনের বেলুন বিক্রিতে চলে সংসার
রাজধানীর সায়েন্সল্যাব এলাকায় ১৯ জুলাই হেলিকপ্টার থেকে আসা গুলিতে নিহত হন আল আমিন শুভ। নিজে গ্যারেজে কাজ করে ছোট তিন বোন ও ভাইকে লেখাপড়া করাতেন। শুভর মৃত্যুর পর চতুর্থ শ্রেণির মীম ও তৃতীয় শ্রেণি পড়ুয়া দুই বোন– সুমি ও রুমি বেলুন বিক্রি করে সংসারের হাল ধরেছে।
শুভর মা রেণু বেগম বলেন, ‘শুধু নিঃশ্বাসটা আসে-যায়। ভেতরে কিছুই নেই। কেউ যদি বলত আমার জীবনের বিনিময়ে আমার ছেলে বাঁচবে, আমি তাই করতাম। হাসতে হাসতে জীবনটা দিয়ে দিতাম।’ তিনি বলেন, ‘আমরা কষ্ট করে চলি। তবুও ছেলের মৃত্যুর দিনে ডাল-চালে শিরনি রেঁধে অসহায়দের খাওয়াব। মিলাদ পড়াব।’
প্রতিটি প্রাণ অসমাপ্ত এক গল্প
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ হয়েছেন মায়া ইসলাম, মেহেরুন নেছা, লিজা, রিতা আক্তার, নাফিসা হোসেন মারওয়া, নাছিমা আক্তার, রিয়া গোপ, কোহিনূর বেগম, সুমাইয়া আক্তার, মোসা. আক্তার ও নাঈমা সুলতানা। নামগুলো এক একটি সংখ্যা। কিন্তু এর পেছনে আছে অজস্র কান্না; আছে শেষ চিৎকার! আছে অন্ধকারে ঢাকা ভবিষ্যৎ। প্রতিটি প্রাণ যেন আমাদের সামনে রেখে গেছে একটি অসমাপ্ত গল্প।
প্রকাশক ও সম্পাদকঃ অ্যাডভোকেট মোঃ শরীফ মিয়া
অফিস ঠিকানা: বাড়ি নং ১৫ (৬ষ্ঠ তলা), রোড নং ১৯, সেক্টর নং ১১, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০
somriddhabangladesh@gmail.com
Copyright © 2025 দৈনিক সমৃদ্ধ বাংলাদেশ. All rights reserved.