ঢাকার নারায়ণগঞ্জের গণপরিবহন কর্মী আব্দুল মান্নান মনে করেছিলেন, তিনি আয়ের একটি অতিরিক্ত উপায় খুঁজে পেয়েছেন। একটি ফেসবুক বিজ্ঞাপন দেখে তিনি একটি ওয়েবসাইটে রেজিস্ট্রেশন করেন এবং এক হাজার টাকা জমা দেন। তাকে লোভনীয় প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল: প্রতিদিন কিছু অনলাইন অ্যাড দেখলেই ৬০০ টাকা আয় করা যাবে। তিনি সব নির্দেশনা মেনেছিলেন, কিন্তু কোনো অর্থই পাননি। তার জমা করা টাকা উধাও হয়ে গেল এবং প্ল্যাটফর্মটি তার বার্তাগুলোর উত্তর দেয়া বন্ধ করে দেয়।
মান্নান একা নন। বাংলাদেশজুড়ে এমন অসংখ্য ওয়েবসাইট সক্রিয় আছে, যেগুলো সহজ কাজ (যেমন অ্যাড দেখা) করার বিনিময়ে দৈনিক আয়ের প্রলোভন দেখাচ্ছে। ফেসবুক বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে এগুলোকে ব্যাপকভাবে প্রচার করা হচ্ছে।
এসব প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারকারীদের রেজিস্ট্রেশন করতে এবং আগাম অর্থ জমা দিতে বলে প্রায়ই ‘সিলভার’ বা ‘প্লাটিনাম’ প্যাকেজের নামে দৈনিক রিটার্নের প্রতিশ্রুতি দেয়। বাস্তবে, তারা কোনো টাকাই ফেরত দেয় না।
কমপক্ষে ৩১টি ফেসবুক পৃষ্ঠা এমন স্ক্যাম ওয়েবসাইটের বিজ্ঞাপন চালাচ্ছে। বিজ্ঞাপনগুলোতে বাংলায় লেখা ছিল— ‘অ্যাড দেখে ইনকাম করুন,’ ‘ইনকাম ওয়েবসাইট’—যেগুলো মূলত রিমোট কাজ বা দ্রুত আয়ের সন্ধানকারী ব্যবহারকারীদের টার্গেট করে।
গবেষণায় দেখা গিয়েছে, এই পেজ ও ওয়েবসাইটগুলো চক্রাকারে কাজ করে: কিছু বন্ধ হয়ে যায়, আবার নতুনগুলো চালু হয়। কিছু পৃষ্ঠা বিজ্ঞাপন চালানোর পর দ্রুতই বন্ধ হয়ে যায়, কিন্তু একই বা অনুরূপ স্কিম নিয়ে নতুন পেজ কয়েক দিনের মধ্যেই চালু হচ্ছে।
ফেসবুক বিজ্ঞাপন থেকে প্রতারণার ওয়েবসাইট: স্কিমটি কিভাবে কাজ করে?
চলতি বছরের ৬ ও ১২ মে মেটা অ্যাড লাইব্রেরিতে অনুসন্ধান করে দেখা যায়, ৩১টি ফেসবুক পেজ থেকে চালানো প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপনগুলো ব্যবহারকারীদের ২৫টি ভিন্ন ওয়েবসাইটে নিয়ে যাচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে একাধিক পেজ একই সাইটকে প্রমোট করছে। একটি প্ল্যাটফর্ম কমপক্ষে তিনটি ফেসবুক পেজ দিয়ে বিজ্ঞাপন দেয়া হচ্ছিল।
২৪ জুন পর্যন্ত এই ওয়েবসাইটগুলোর বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২৫টির মধ্যে মাত্র ৭টি সক্রিয় আছে। এদিকে, একই ধরনের প্রতারণার প্রচারণা নতুন ফেসবুক পৃষ্ঠা থেকে চালানো হচ্ছে, যা ব্যবহারকারীদের নতুন স্ক্যাম ওয়েবসাইটে নিয়ে যাচ্ছে। ২৪ জুন কমপক্ষে ৩১টি নতুন ফেসবুক পৃষ্ঠায় একই ধরনের বিজ্ঞাপন চালানো হচ্ছিল।
এই ফেসবুক বিজ্ঞাপনগুলো ৫-৬ মিনিটের ভিডিও আকারে চালানো হয়। প্রথম ৩০ সেকেন্ড থেকে ১ মিনিটে বাংলাদেশের জনপ্রিয় ইউটিউবার শোহাগ খন্দকার ও এএফআর টেকনোলজির (প্রতিটির ৪ মিলিয়নের বেশি সাবস্ক্রাইবার) ভিডিও ক্লিপ ব্যবহার করা হয়।
মূল ভিডিওতে ফেসবুক ভিডিও দেখে বা রিয়েক্ট করে আয়ের উপায় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, কিন্তু কোনো ওয়েবসাইটে রেজিস্ট্রেশন বা টাকা জমা দেয়ার কথা বলা হয়নি।
এরপর স্ক্যাম বিজ্ঞাপনগুলো মোবাইল স্ক্রিন রেকর্ডিং দেখায়—কিভাবে একটি ওয়েবসাইটে রেজিস্ট্রেশন করে, ডিপোজিট দিয়ে, অ্যাড দেখে দৈনিক আয় করা যায়। বিজ্ঞাপনে ক্লিক করলে ব্যবহারকারীদের একটি ওয়েবসাইটে রিডাইরেক্ট করা হয়।
এই ওয়েবসাইটগুলোর গঠন প্রায় একই রকম: ব্যবহারকারীদের রেজিস্ট্রেশন করতে হয়, তারপর বিকাশ, নগদ বা রকেটের মাধ্যমে ৫০০ থেকে ২০,০০০ টাকার ‘আয় প্যাকেজ’ কিনতে হয়। বিনিময়ে, অনলাইন অ্যাড দেখার মতো সহজ কাজ করে দৈনিক আয়ের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। যেমন, ৫০০ টাকার প্যাকেজে ২০০ দিন ধরে, দিনে ৩০০ টাকা আয়ের দাবি করা হয়।
ডোমেইন ও হোস্টিং প্যাটার্ন
এই ওয়েবসাইটগুলোর মধ্যে অস্বাভাবিক মিল রয়েছে। প্রতিটিতে অনলাইন অ্যাড দেখে আয়ের সুযোগ দেয়ার দাবি করা হয়। নিচে বিকাশ, নগদ ও রকেটের লোগো থাকে। ২৪টি ওয়েবসাইটের মধ্যে ২৩টিতে একই ধরনের বাটন (‘ডিপোজিট’, ‘উইথড্র’, ‘টাস্ক’, ‘প্ল্যান’, ‘রেফার’) একই লেআউটে সাজানো।
WHOIS রেকর্ড পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, অধিকাংশ ডোমেইন এপ্রিল-মে ২০২৫-এ রেজিস্ট্রি করা হয়েছে। কিছু ডোমেইন একই রেজিস্ট্রার ও হোস্টিং প্রোভাইডার ব্যবহার করেছে।
ফেসবুকের এই স্ক্যাম বিজ্ঞাপনের নিচে কিছু ব্যবহারকারী অন্যদের সতর্ক করার চেষ্টা করেছেন। কমপক্ষে ৩০ জন লিখেছেন যে তারা টাকা জমা দিয়েছেন কিন্তু কিছু পাননি।
কিন্তু এ ধরনের মন্তব্যগুলো ‘জাল প্রশংসার’ নিচে চাপা পড়ে যায়। গবেষণা করে দেখা যায়, ১০টি স্ক্যাম-সম্পর্কিত পোস্টের ৪,৮০৯টি মন্তব্যের মধ্যে ৭৯% একই বার্তার পুনরাবৃত্তি।
ইনফ্লুয়েন্সারদের নাম ব্যবহার করে টার্গেট কাস্টমারের বিশ্বাস গড়া
কিছু বিজ্ঞাপনে শোহাগ খন্দকার ও এএফআর টেকনোলজির ভিডিও ক্লিপ ব্যবহার করা হয়েছে, যা তাদের অনুমতি ছাড়াই সম্পাদনা করে যোগ করা হয়েছে। পরে স্ক্রিন রেকর্ডিং দেখানো হয় কীভাবে ওয়েবসাইটে টাকা জমা দিতে হয়—যেন এই ইউটিউবাররাই এটি সমর্থন করছেন।
মেটার যেসব নীতিমালা লঙ্ঘন করছে এসব বিজ্ঞাপন
এই স্ক্যাম প্রচারণাগুলো মেটার দুটি নীতিমালা লঙ্ঘন করছে:
১. অনুমতি ছাড়া ইউটিউবারদের নাম ও ভিডিও ব্যবহার করে বিভ্রান্তি ছড়ানো।
২. অগ্রিম ফি নিয়ে আয়ের প্রতিশ্রুতি দেয়া।
তবুও, এই বিজ্ঞাপনগুলো কিছুদিন কিংবা সপ্তাহ ধরে চালানো হয়েছে। কিছু পেজ শুধুমাত্র একাধিক বিজ্ঞাপন চালানোর পর বন্ধ করা হয়েছে।
সূত্র: ডিসমিসল্যাব।