মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডসহ দণ্ডাদেশ ঘোষণা করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। গত বছরের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের সময় ছাত্র-জনতার ওপর সংঘটিত অপরাধ নিয়ে দায়ের করা মামলার ভিত্তিতে এই ঐতিহাসিক রায় দেওয়া হয়।
সোমবার বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারকে প্রধান করে গঠিত তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল–১ এ রায় ঘোষণা করে। আদালতজুড়ে ছিল টানটান উত্তেজনা—আইনজীবীদের পাশাপাশি তখনকার সহিংসতায় নিহতদের স্বজনেরাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
রায়ে বলা হয়—শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনা তিনটি অভিযোগই প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে একটির জন্য তাকে আমৃত্যু কারাদণ্ড এবং বাকি দুই অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
বিচার শুরুর আগেই বাংলাদেশ, ভারতের কাছে শেখ হাসিনাকে ফেরত পাওয়ার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন নথিপত্র পাঠিয়েছিল। যদিও দুই দেশের মধ্যে প্রত্যর্পণ চুক্তি বিদ্যমান, তবুও ভারত এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনও বক্তব্য দেয়নি।
রায় ঘোষণার পর দেশ-বিদেশে প্রশ্ন উঠেছে—ভারত কি এবার পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে হস্তান্তর করবে?
কাতারভিত্তিক আল জাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ভারতের জিন্দাল গ্লোবাল বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিশ্লেষক শ্রীরাধা দত্ত জানান, “এই রায় প্রত্যাশিতই ছিল। তবে ভারত হাসিনাকে কোনোভাবেই ফেরত দেবে না।” তার ভাষায়, গত দেড় বছরে দুই দেশের সম্পর্কে ভঙ্গুরতা ছিল স্পষ্ট।
তিনি আরও বলেন, দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি ইঙ্গিত দিচ্ছিল—হাসিনার বিচার কঠোরই হবে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার পর্যবেক্ষকদের মতে, ট্রাইব্যুনালের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া বাংলাদেশের আইনি কাঠামো মেনেই হয়েছে।
“নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রমাণ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। এমনকি গুলি চালানোর নির্দেশ দেওয়ার মতো প্রমাণও আদালতে উপস্থাপিত হয়েছে।”
শ্রীরাধার মতে, আওয়ামী লীগ তাদের পক্ষ থেকে পাল্টা ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করবে; কিন্তু অধিকাংশ বাংলাদেশির দৃষ্টিতে, হাসিনা মানবতাবিরোধী অপরাধে দায়ী।
প্রত্যর্পণ চুক্তির মূল কাঠামো
২০১৩ সালে ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক প্রত্যর্পণ চুক্তি স্বাক্ষর করে; ২০১৬ সালে এতে সংশোধন আনা হয়, যাতে দুই দেশের মধ্যে পলাতক আসামি বিনিময় আরও দ্রুত ও সহজ হয়।
এই চুক্তি মূলত দুই দেশের নিরাপত্তা–সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ, বিশেষ করে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী ও বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের যাতায়াত–কেন্দ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় তৈরি হয়।
এই চুক্তির অধীনেই ২০১৫ সালে উলফার শীর্ষ নেতা অনুপ চেটিয়াকে বাংলাদেশ থেকে ভারতে ফেরত নেওয়া হয়েছিল। পরবর্তী বছরগুলোতেও দুই দেশ একে অপরের কাছে পলাতক অপরাধী ফেরত দিয়েছে।
চুক্তি অনুযায়ী, যে ব্যক্তি মামলা, অভিযোগ বা দণ্ডাদেশের মুখোমুখি—এবং প্রত্যর্পণযোগ্য অপরাধে যুক্ত—তাকে দুই দেশই একে অপরের অনুরোধে ফেরত দিতে পারে।
কিন্তু আইনি নিয়মের বাইরেও এখানে বড় বিষয় হলো—রাজনৈতিক স্থিতি, ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ এবং মানবাধিকার বিবেচনা, যা বিষয়টিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
পাঞ্জাবের রাজীব গান্ধী ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির আইন বিশেষজ্ঞ ড. সঙ্গীতা তাক জানান—বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যর্পণের আবেদন জমা দিয়েছে, যেখানে অভিযোগের বিবরণ, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ও সহায়ক প্রমাণপত্র জমা থাকা বাধ্যতামূলক।
তিনি জোর দিয়ে বলেন—প্রত্যর্পণের আবেদনে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হয় যে অভিযুক্ত ব্যক্তি বাংলাদেশে ন্যায্য ও পক্ষপাতহীন বিচার পাবেন।
সূত্র: আল জাজিরা, দ্য ডিপ্লোম্যাট



